
বাদল রায় স্বাধীন : পদবী প্রশিক্ষক হলেও আবদুল খালেকই সন্দ্বীপ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের সর্বেসর্বা। সদ্য বদলি হওয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা(অঃ দাঃ) এস.এম. জিন্নাত সুলতানা বছরের পর বছর কার্যালয়ে অনুপস্থিতির সুযোগ ও আশ্রয় প্রশ্রয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত কিশোর কিশোরী ক্লাব স্থাপন প্রকল্পের জেন্ডার প্রমোটর, সংগীত, আবৃত্তি শিক্ষক, ক্লাব কো-অর্ডিনেটরদের ভাতা/সম্মানী ও ক্লাব সদস্যদের নাস্তার টাকা আত্মসাৎ, অবৈধভাবে নাস্তা বিতরনের জন্য আত্মীয়কে ঠিকাদার নিয়োগ,ক্লাবগুলোতে মনিহারী সামগ্রী বিতরনে অনিয়ম এবং শিক্ষকদের ভূয়া নোটিশ দিয়ে চাকুরীচ্যুত করার ভয় ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ উঠেছে আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে।
২৬ মে আবদুল খালেকের নানান অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট মৌখিক অভিযোগ দেন ক্লাবগুলোর জেন্টার প্রমোটর, সংগীত ও আবৃত্তি শিক্ষকের প্রায় ৯৫ ভাগ। বাকিরা সেদিন অনুপস্থিত না থাকলে ১০০ ভাগের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
শিক্ষার্থীদের নাস্তার টাকা প্রশিক্ষকের পেটে-
প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দের কাগজপত্র ও উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়,২০২১ সালের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত উপজেলার ১৬ টি ক্লাবের জন্য(প্রতি মাসে ৮ কার্যদিবস, প্রতিটি ক্লাবে ৩৫ জন সদস্য, প্রতি সদস্যের জন্য ৩০ টাকা হিসেবে) ৭,০৫,৬০০ টাকা বাজেট বরাদ্দ আসে। সেখান থেকে ভ্যাট ও আইটি কেটে উত্তোলন করা হয় ৬,৩১,৫১২ টাকা। অভিযোগ উঠেছে উত্তলিত টাকার সিংহভাগই নাস্তা বাবদ ব্যায় না করে নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন আবদুল খালেক।
প্রকল্পের চারটি ক্লাবের দায়িত্বে থাকা লুবনা খানম অভিযোগ করে বলেন, গত বছরের অক্টোবর থেকে আজ অব্দি নাস্তা বাবদ কোন টাকা পাইনি। আমি নিজের টাকায় বাচ্চাদের নাস্তা করিয়েছি, পরে পাবো এ আশায়। আবদুল খালেক বলেছিলেন দোকান ঠিক করে দেবেন নাস্তার জন্য। দেকানদারকে টাকা উনি দেবেন। কিন্তু ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও ওনার কোন খবর নেই।’
ক্লাবগুলোতে কর্মরত চার জন জেন্ডার প্রমোটরের সঙ্গে কথা জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের নাস্তা খাওয়ানোর জন্য আগে জেন্ডার প্রমোটরদেরকে সামান্য টাকা দেওয়া হতো। পুরো নাস্তার বিল না দিলেও টাকা নেওয়ার আগে সাদা কাগজে বুঝিয়া পাইলাম লিখে নিতেন আবদুল খালেক। এবছর মার্চ মাসে কোন প্রকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই অবৈধভাবে তার এক আত্মীয়কে ক্লাবগুলোর সদস্যদের মাঝে নাস্তা বিতরনের ঠিকাদারী দেন আবদুল খালেক ।
অবৈধভাবে ঠিকাদার নিয়োগের ব্যাপারে জানতে চাইলে আবদুল খালেক বলেন, ‘ক্লাস ও নাস্তা বিতরনের বিষয়টি মনিটরিং করার দায়িত্ব সুপারভাইজারের। সুপারভাইজার সন্দ্বীপ আসেন না। মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাও আসেন না। জেন্ডার প্রমোটররা নাস্তার টাকা নিয়ে গিয়ে নাস্তা বিতরন করেন না। ক্লাবের স্বার্থে নাস্তাগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জেলা সুপারভাইজরের প্রস্তাব অনুযায়ী, নির্বাহী অফিসারের মৌখিক পরামর্শেই নাস্তা সরবরাহের জন্য একজন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়।’
১৬ টি ক্লাবের সপ্তাহে দুই দিন করে ক্লাস এবং প্রতি ক্লাসে ৩৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩০ টাকা করে নাস্তার বিল উত্তোলন করা হলেও সরেজমিনে ক্লাবগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্লাবেই একটি ক্লাসে ১০/১৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী উপস্তিত থাকে না। দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন ক্লাবের তিনটি ক্লাসের জিপিএস ক্যামেরায় তোলা হাজিরার ছবিতে দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চ মাসের ৪ তারিখে উপস্থিত ছিলো ৫ জন, ৩ তারিখ উপস্থিত ছিল ৯ জন ও মে মাসের ২০ তারিখ উপস্থিত ছিলো ৫ জন শিক্ষার্থী। বাউরিয়া ইউনিয়ন ক্লাবের মে মাসের ১৩ তারিখের ক্লাসে ৩ জন, হারিশপুর ক্লাবে ১০ জন এবং মুছাপুর ক্লাবে উপস্থিত ছিলো ৬ জন শিক্ষার্থী।
দীর্ঘাপাড় ক্লাবের সংগীত শিক্ষক.. বলেন, ‘আমার ক্লাবটি বেড়িবাঁধের বাইরে চরের মাঝখানে হওয়ায় বাচ্চারা আসতে চায় না। নাস্তা খাওয়াবো বললে অল্প কয়েকজন আসে। ক্লাবের সামনে একটা দোকান থেকে ৪ মাস ধরে আমি নিজের টাকায় নাস্তা কিনে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছি। অফিস থেকে নাস্তা বাবদ এখন পর্যন্ত এক টাকাও পাইনি।
দীর্ঘাপাড় ক্লাবে ক্লাস শেষ কথা হয় একধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা বলেন, ‘আমাদের ১০ টাকা দামের একটা জুস, ৫ টাকা দামের একটা কেক দেয় ক্লাসে। অনেক সময় কেউ শুধু কেক পায়, কেউ শুধু জুস পায়।’
নাস্তার টাকা অনিয়মের অভিযোগ স্বীকার করে আবদুল খালেক বলেন-‘দীর্ঘাপাড় ক্লাবের প্রকল্পের শুরু থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত হাজিরা অনুযায়ী নাস্তার টাকা ক্লাবের দায়িত্বে থাকা জেন্ডার প্রমোটর সিদ্দিক উল্লাহকে দিয়ে দিয়েছি। সে যদি বাচ্চাদের নাস্তা না করায় তাহলে আমার কিছু করার নেই।’তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ভ্যাট বাদ দিয়ে নাস্তা বাবদ ৩, ৪৪, ০০০ টাকা উত্তোলন করেছি। তার মধ্যে ৯৭,৬০০ টাকা এখনও আমার কাছে আছে।’
জানা যায়, নাস্তার বিলের অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে জানাজানি হলে আবদুল খালেক তড়িঘড়ি করে ৩০ মে মাইটভাঙা ও মগধরা ইউনিয়ন ক্লাবের দুজন শিক্ষককে ৫৩,৬০০ টাকা দিয়ে দেন।
নাস্তার বিলের অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে তৎকালীন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা(অঃদাঃ)এস.এম. জিন্নাত সুলতানা বলেন, ‘যেহেতু আমি সন্দ্বীপ সরেজমিনে দেখতে পারতাম না, চাইতাম উপজেলার সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে চলুক। এতো অনিয়মের খবর এতোদিন আমিও জানতাম না।’
শিক্ষকদের বেতনে নয় ছয়ঃ
জেন্ডার প্রমোটররা দৈনিক ১০০০ টাকা ভাতা হিসেবে মাসে ৮টি ক্লাসে পান ৮০০০ টাকা। সংগীত ও আবৃত্তি শিক্ষকেরা দৈনিক ৫০০ টাকা ভাতা হিসেবে মাসে ৪টি ক্লাসে পান ২০০০ টাকা। শিক্ষকদের ক্লাসে অনুপস্থিত দেখিয়ে তাদের বেতনদের টাকাও আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে।
বাউরিয়া, আমানউল্লা, গাছুয়া, সন্তোষপুর ইউনিয়নের চারটি ক্লাবের দায়িত্বে থাকা জেন্ডার প্রমোটর ওমর ফারুক বলেন, ‘ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে ১৮ হাজার টাকা বেতনের মধ্যে আমি পেয়েছে মাত্র ৪ হাজার টাকা। আমার ৪ টি ক্লাবের ৮ জন সংগীত ও আবৃত্তি শিক্ষকের মধ্যে বেতন পেয়েছে মাত্র দুই জন। বাকি ৬ জনকে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এক টাকাও বেতন দেওয়া হয়নি। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসেও আমরা পূর্ণ বেতন পাইনি।’
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৬ টি ক্লাবের জেন্ডার প্রমোটর, সংগীত ও আবৃত্তি প্রশিক্ষকদের বেতন বাবদ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বরাদ্দ আসে ১,০৮,০০০ টাকা,২০২২ সালের জানুয়ারিতে ১,০৮,০০০ টাকা, ফেব্রয়ারিতে ৫৬,০০০ টাকা এবং মার্চে বরাদ্দ আসে ৮০,০০০ টাকা। চার মাসে মোট বরাদ্দ আসে ৩,৫২,০০০ টাকা।
উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ৩,৫২,০০০ টাকা থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর ও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভ্যাট ও আইটি বাদ দিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ১,৩৬,৫০০ টাকা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে উত্তোলন করা হয়েছে ১,৩৬,০০০ টাকা।
শিক্ষকদের বেতন বিলের কাগজপত্র থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর ও ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ৩২ জন সংগীত ও আবৃত্তি শিক্ষকের মধ্যে ৭ জন শিক্ষক এক টাকাও বেতন পাননি। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে যাদের অনুপস্থিত দেখিয়ে বেতন দেওয়া হয়নি ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসেও তাদের অনুপস্থিত দেখিয়ে দেওয়া হয়নি এক টাকাও বেতন। বাকিদের কেউ পেয়েছেন অর্ধেক বেতন, কেউ পেয়েছেন এক চতুর্থাংশ।
জিপিএস ক্যামেরায় তোলা ২০২২ সালের মার্চ মাসের ৩ টি ক্লাসের ছবি দেখিয়ে বেতন বঞ্চিত গাছুয়া ইউনিয়ন ক্লাবের আবৃত্তি শিক্ষক বিদ্যুৎ কুমার রায় বলেন, ‘যথারীতি ক্লাস করলেও দুঃখের বিষয় আমাকে চার মাসের ক্লাস বাবদ প্রাপ্য ভাতার মধ্যে দেওয়া হয়েছে মাত্র একটি ক্লাসের ৫০০ টাকা ভাতা।’
শিক্ষকদের ক্লাসে অনুপস্থিত দেখালেও ওসব না হওয়া ক্লাসগুলোর জন্য ঠিকই উত্তোলন করা হয়েছে নাস্তার বিল।মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন আবৃত্তি প্রশিক্ষক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমি নিয়মিত ক্লাস করিয়েছি এবং জিপিএস ক্যামেরায় ক্লাসের ছবি থাকার পরও গতবছর ডিসেম্বর থেকে এবছর মার্চ পর্যন্ত আমি এক টাকাও বেতন পাইনি। ক্লাস হয়নি দেখিয়ে আমার বেতন কেটে রাখা হয়েছে, অথচ না হওয়া ক্লাসগুলোর নামে আসা নাস্তার টাকা ক্লাস হয়েছে দেখিয়ে তুলে নিয়েছেন আবদুল খালেক। এর চেয়ে বড় দূর্নীতির প্রামাণ আর কী হতে পারে?’
ক্লাস করার পরও ভাতা না পাওয়া শিক্ষকের দেখা যেমন মিলেছে, ক্লাস না করিয়ে ভাতা পাওয়া শিক্ষকেরও দেখা মিলেছে প্রকল্পের কাগজপত্র ঘেঁটে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ একদিনও ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেও চার সপ্তাহের ভাতা পেয়েছেন আমানউল্ল্যা ইউনিয়ন ক্লাবের সংগীত শিক্ষক। আমানউল্ল্যাহ ইউনিয়ন ক্লাবের আবৃত্তি শিক্ষক জেসমিন বেগম বলেন, ‘২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আমার ক্লাবের সংগীত শিক্ষককে কখনো ক্লাস করতে দেখিনি। ওনার ক্লাসগুলোও আমি করিয়েছি। আমার বেতন কাটা গেছে অথচ ওনার চার সপ্তাহের বেতন এসেছে।’
আবৃত্তি ও সংগীত শিক্ষকদের ক্লাসে অনুপস্থিত দেখিয়ে ভাতা কেটে নিলেও সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলোতে কর্মরত আবদুল খালেকের ঘনিষ্ঠ দুজন জেন্ডার প্রমোটরকে পূর্ণ ভাতা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ক্লাবগুলোর আবৃত্তি ও সংগীত শিক্ষকেরা। প্রকল্পের কাগজপত্রে মিলেছে অভিযোগের সত্যতা।
আবৃত্তি প্রশিক্ষক বাদল চন্দ্র রায় ক্লাবে কর্মরত জাতীয় পর্যায়ে লেখালেখি ও সাংবাদিকতা করেন এমন কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘সুকৌশলে ক্লাবগুলোতে দায়িত্বরত সচেতন ও প্রতিবাদী লোকগুলোকে ক্লাবের কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তৎকালীন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার যোগসাজসে আবদুল খালেক এসব অনৈতিক কর্মকান্ড করেছেন। সচেতনরা ক্লাব থেকে চলে গেলে তখন সে নির্বিঘ্নে লুটপাট চালিয়ে যেতে পারবে। প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না।’
তথ্য প্রমাণসহ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রসঙ্গে আবদুল খালেক বলেন, আমি ২০২১ সালের ডিসেম্বর ও ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রত্যেকের সম্পূর্ণ হাজিরা পাঠিয়েছি। তৎকালীন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জিন্নাত সুলতানা জেন্ডার প্রমোটর ও শিক্ষকদের হাজিরা কর্তন করে বেতন করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ তৎকালীন সুপারভাইজার সবুজ খান সন্দ্বীপ এসে ১ দিন ফিল্ড ভিজিট করে যে রিপোর্ট পেয়েছেন,সে তথ্য অনুযায়ী ঢাকা থেকে বাজেট পাঠিয়েছে। বাজেট অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি -মার্চের বেতন হয়েছে। হাজিরা দিয়েছেন তৎকালীন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জিন্নাত সুলতানা।’
মাত্র এক দিন সন্দ্বীপ এসে কীভাবে জেন্ডার প্রমোটরদের হাজিরার রিপোর্ট ঢাকা পাঠিয়েছেন জানতে চাইলে তৎকালীন সুপারভাইজর সবুজ খান বলেন, ‘আমি ৭-২-২০২২ তারিখে সুপারভাইজরের সন্দ্বীপের দায়িত্ব পেয়ে ১১-২-২০২২ তারিখে ৪ টি ক্লাব ভিজিট করি। সেখানে শিক্ষক অনুপস্থিত সহ অনেক অনিয়ম দেখতে পাই এবং বিষয়টি মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মহোদয়কে তাৎক্ষণিক ফোন অবহিত করে ব্যবস্থা নিতে বলি। এর পরে আমি পরের সপ্তাহে জেন্ডার প্রোমোটরদের কাছে ক্লাসের ছবি চাই। তারা কিছু ছবি দেয় আর বলে বাকিরা ছবি দেয়নি, কেউ কেউ ফোন ধরে নি। সেটাও আমি জনাব খালেদ সহ ম্যাডাম কে জানাই।১-৩- ২০২২ তারিখে আমাকে আবার চট্টগ্রাম হতে বদলী করা হয় । সন্দ্বীপে আমার কর্ম দিবস মাত্র ২২ দিন । আমার নামে যারা মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছেন আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার নিব।’
তৎকালীন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা এস.এম. জিন্নাত সুলতানা বলেন, ‘আমি সন্দ্বীপে সরেজমিনে গিয়ে তদারকি করতে পারতাম না। আবদুল খালেক যা হাজিরা পাঠাতো তাই ওকে করে দিতাম। ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সুপারভাইজার সন্দ্বীপ যায়। আমাকে বলে সন্দ্বীপ অনিয়ম চলছে। এরপর আমি খালেকের পাঠানো হাজিরা পুরোপুরি পাশ করিনি।
যারা ক্লাস করেও টাকা পায়নি,আবদুল খালেক ওদের হাজিরাও আমার কাছে পাঠায়নি।’
কো-অর্ডিনেটরদের সম্মানী গায়েবঃ
১৬ টি ক্লাবের ৪ জন জেন্ডার প্রমোটর, ৩২ জন আবৃত্তি ও সংগীত শিক্ষকের পাশাপাশি রয়েছেন ১৬ জন কো অর্ডিনেটর।পৌরসভা ও ইউনিয়নের মহিলা কাউন্সিলর/ মেম্বাররা হন ক্লাব কো অর্ডিনেটর। তাদের জন্যও রয়েছে সম্মানী। সে সম্মানীর টাকাও মেরে খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৬ জন কো অর্ডিনেটরের জন্য ২০২১সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ক্লাব প্রতি ২০০০ টাকা করে ৫ মাসে ১০০০ টাকা হিসেবে মোট বরাদ্দ আসে এক লক্ষ ষাট হাজার টাকা। ২০১৯ সালে ৫০০০ টাকা করে সম্মানী বাবদ ১৬ জনের জন্য বরাদ্দ আসে আশি হাজার টাকা।
ক্লাব কো অর্ডিনেটরদের জন্য বরাদ্দ হওয়া অর্থের খবর জানেন না বেশিরভাগ কো অর্ডিনেটর। কেউ কেউ জানালেও পান নি এক টাকাও।
কো অর্ডিনেটরদের সম্মানী বাবদ কোন টাকা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে
দীর্ঘাপাড় ক্লাবের কো অর্ডিনেটর দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নের ৪,৫,৬ নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার রুমা আক্তার বলেন, ‘ আমি এক টাকাও পাইনি। জাহেদ নামের একজন জেন্ডার প্রমোটর ফোন দিয়ে টাকা দেবে বলেছিল।এরপর যতবার ফোন দিয়েছি নাম্বার বন্ধ পেয়েছি। টাকাগুলো কীভাবে পাবো যোগাযোগ করার জন্যও একটা নাম্বার দিয়েছিল। ওই নাম্বার থেকেও আমাকে ব্লক করে দিয়েছে।’
বাউরিয়া ক্লাবের কো অর্ডিনেটর বাউরিয়া ইউনিয়নের ৭,৮,৯ নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার শাহানারা বেগম বেবী বলেন,’ আমি স্কুলে গিয়ে স্যারদের সঙ্গে আলাপ করে ছাত্র ছাত্রী জোগাড় করেছি। নিজে গান গেয়ে ছাত্র ছাত্রীদের আগ্রহী করেছি। নিজের পয়সা খরচ করে ছাত্র ছাত্রীদের নাস্তা করিয়েছি। নাস্তার টাকাও পাইনি, আমার সম্মানীর পুরো টাকাটাও পাইনি।’
মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন ক্লাবের কো অর্ডিনেট মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের ৪,৫,৬ নং ওয়ার্ড মেম্বার শারমিন আক্তার স্বপ্না বলেন, ‘আমি কোন টাকা পাইনি। এখানে যে প্রকল্প আছে সেটাও আমি জানি না।’
কো-অর্ডিনেটরদের সম্মানীর অর্থ লুটপাটের অভিযোগ স্বীকার করে আবদুল খালেক বলেন, ‘৫ জন কো অর্ডিনেটরের টাকা এখনও দেওয়া হয়নি। এটা আমার ভুল হয়েছে। নানান ঝামেলার কারনে ওনাদের টাকাগুলো দিতে পারিনি।’
মনিহরী সামগ্রী ক্রয়ে অনিয়মঃ
ভাতা/সম্মানীর অর্থ অত্মসাৎ করার পাশাপাশি ক্লাবগুলোর জন্য আসা মনিহারী বাবদ বরাদ্দের অর্থের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে।
প্রকল্পের সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মনিহারী বাবদ সন্দ্বীপ উপজেলার ১৬ ক্লাবের জন্য ক্লাবপ্রতি ৩০০০ টাকা করে মোট ৪৮,০০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে সে টাকায় ক্লাবগুলোর জন্য কোন মনিহারী কেনা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল খালেক বলেন,ক্লাবের সাংস্কৃতিক উপকরন ও ক্রীড়া সামগ্রীর জন্য বাজেট বরাদ্দ আসলেও কোন পরিবহন খরচ দেওয়া হয়নি। সাংস্কৃতিক উপকরণ কেনার পর টাকা মেলাতে না পারায় জেলা থেকে অানঅফিসিয়ালি পরামর্শ দিয়েছিল আনুসাঙ্গীক থেকে খরচ করতে। মনিহারীর টাকাগুলো ওখানে খরচ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত অর্থবছরের ন্যায় এবছরের জানুয়ারির ২৭ তারিখ মনিহারী বাবদ বরাদ্দ এসেছে ৪৮,০০০ টাকা। উত্তোলন করা হয়েছে ৪২,৯৬০ টাকা। সেখান থেকে ১৬ টি ক্লাবের জন্য মনিহারী ক্রয় করা হয়েছে মাত্র দশ হাজার টাকার।
বাকি টাকা কি করছেন জানতে চাইলে আবদুল খালেক বলেন,’ বাকি ৩২ হাজার টাকা কিশোর কিশোরী ক্লাবের ফান্ড জমা আছে।’
চাকরীচ্যুত করার হুমকীঃ
১৯.১১.২০১৯ তারিখে কিশোর কিশোরী ক্লাব স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বিকাশ চন্দ্র সিকদারের স্বাক্ষরিত একটি নিয়োগপত্র থেকে জানা যায়,চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলায় ১৬ টি ক্লাবে ১৬ জন আবৃত্তি শিক্ষক,১৬ জন সংগীত শিক্ষক ও ৪ জন জেন্ডার প্রমোটরকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
নিয়োগের দুই বছর না পেরুতেই ১৪.১১.২০২১ তারিখে তৎকালীন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা(অঃদাঃ) এস.এম. জিন্নাত সুলতানার স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ সংগীত ও আবৃত্তি শিক্ষকদের হাতে ধরিয়ে দেন আবদুল খালেক।নোটিশে বলা হয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে পর্যাপ্ত দরখাস্ত পাওয়া না যাওয়ায় প্রধান কার্যালয়ের মৌখিক পরামর্শে শুধুমাত্র ক্লাবের কার্যক্রম চালু করার নিমিত্তে উপজেলা বাছাই কমিটি কর্তৃক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স এবং চাকুরিরত প্রার্থীদের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের শর্ত শিথিল করে আগ্রহী প্রার্থীদের নিকট থেকে দরখাস্ত গ্রহণ পূর্বক প্রার্থী বাছাই উত্তর নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রেরণ করা হয়।
যে সকল সংগীত শিক্ষক এবং আবৃত্তি শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত সকল শর্ত সমূহ পূরণ করেননি অথবা যাদের পক্ষে উক্ত শর্ত সমূহ পূরণ করা সম্ভব নয় তাদেরকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
একাধিক আবৃত্তি ও সংগীত শিক্ষক অভিযোগ করেন,’এই নোটিশটি ভূয়া এব মনগড়া। এটা প্রকল্প পরিচালক বা মন্ত্রণালয় থেকে আসনি। নোটিশটি দেখার পর আমরা বিভিন্ন উপজেলায় কর্মরত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, পরিচিত আবৃত্তি ও সংগীত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি ওনাদের উপজেলায় এরকম নোটিশ দেওয়া হয়নি। পরে আমাদের তৎপরতা দেখে আবদুল খালেক ভয় পেয়ে আর সামনের দিকে আগায়নি।’
তারা অভিযোগ করেন, ‘আবদুল খালেক আমাদের চাকুরীচ্যুত করে অর্থের বিনিময়ে শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সে কয়েকজনের সঙ্গে চাকরী দেওয়ার অগ্রীম চুক্তিও করেছিল।’
আবদুল খালেক বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে শর্ত পূরণ না করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে নতুন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা এসে বিষয়গুলো দেখার পর,যাতে কোন জবাদিহিতা আসলে জবাব দিতে পারেন,সেজন্য একটি নোটিশ করে রেখেছিলেন।’
নোটিশ প্রদান প্রসঙ্গে তৎকালীন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (অঃদাঃ) এস.এম. জিন্নাত সুলতানা বলেন,’খালেকের বারবার পিড়াপিড়িতে একটা নোটিশ দিতে বলেছি শুধু। কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না বলে দিয়েছিলাম তখন। কারণ আমি জানি কিছু ছাড় না দিলে ক্লাবগুলোতে শিক্ষক পাওয়া যাবে না।’
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক মাধবী বড়ুয়া বলেন, ‘আমি অফিসিয়ালি আমাদের সদর কার্যালয়ে এ ব্যাপারে জানিয়েছি এবং আবদুল খালেককে অলরেডি সন্দ্বীপ থেকে ক্লোজ করা হচ্ছে। সদর দপ্তর ব্যবস্থা নেবে। আমি আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে লিখিত দিয়েছি হেড অফিসে এবং রবিবারের মধ্যে তারা আবদুল খালেককে উড্রো করবে।’
উল্লেখ্য,’ শেখ হাসিনার উন্নয়ন,কৈশোরের জাগরন’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ২০১৯ সালে ২৪ নভেম্বর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ‘কিশোর কিশোরী ক্লাব স্থাপন প্রকল্প’ কর্যক্রমের উদ্বোধন হয়। সারাদেশে প্রত্যেক ইউনিয়নে ১ টি এবং পৌরসভায় ১ টি করে মোট ৪৮৮৩ টি ক্লাস স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পড়েছেনঃ ১১৪