চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল প্লাজায় নারী ক্রেতার মর্যাদাহানি – ‘মাদার ড্রিম’ জুতার দোকানে বিক্রেতার অশোভন আচরণে ক্ষোভ, থানায় জিডি

নিজস্ব প্রতিবেদক :

 

চট্টগ্রাম নগরীর বাণিজ্যিক হৃদস্পন্দন জিইসি মোড় – যেখানে একসময় ‘শপিং’ মানেই ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং পারিবারিক বন্ধনের পরিপূর্ণতা। কিন্তু সেই ঐতিহ্য ও আস্থার প্রতীক সেন্ট্রাল প্লাজা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এক নিন্দনীয় ঘটনার কারণে, যা কেবল একজন নারী ক্রেতার নয়—পুরো নগর সমাজের শালীনতা ও মানবিকতার প্রতি এক চরম আঘাত।

 

এক নিপীড়িত ক্রেতার আর্তনাদ – গত ০১ নভেম্বর ২০২৫, সন্ধ্যা ৬টা ০৫ মিনিটের সময়, শহরের এক তরুণী রিফাত সুলতানা (২৬), তার মা ও শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করেন সেন্ট্রাল প্লাজার দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ‘মাদার ড্রিম’ (Mother Dream) নামের এক জুতার দোকানে। উদ্দেশ্য ছিল জুতা ও ব্যাগ কেনা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কেনাকাটার পরিমণ্ডল পরিণত হয় অশালীনতা, ঔদ্ধত্য ও নারীর মানহানির এক তীব্র দৃশ্যে।

 

ভুক্তভোগীর মা একটি জুতা পরতে চাইলেও সেটি ছোট হওয়ায় তিনি বড় সাইজের অনুরোধ করেন। অথচ দোকানের নাম-না-জানা এক সেলসম্যান জোরপূর্বক জুতাটি তার পায়ে গলিয়ে দেন। এতে ব্যথা পেলে মা জুতা খুলে ফেলেন, কিন্তু বিক্রেতার আচরণ তখনই রূঢ় হয়ে ওঠে। সে কটুভাবে বলে ওঠে – আপনি খুলে আবার পরেন, এটা বড়ই হয়েছে, না হলে রেখে যান।

 

এমন ভাষায় চমকে যান মা ও মেয়ে উভয়েই। উপস্থিত আরও দুইজন নারী ক্রেতাও প্রতিবাদ জানান, কিন্তু বিক্রেতা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রাগান্বিত ভঙ্গিতে জুতাটি কেড়ে নেন এবং অকথ্য গালিগালাজ শুরু করেন।

অসৌজন্যের চূড়ান্ত রূপ : ‘দেখে নেব’ হুমকিতে কাঁপলো পরিবার, ঘটনার প্রতিবাদ করতেই ওই সেলসম্যান প্রকাশ্যেই বলে ওঠে – বেশি কথা বললে দেখে নেব।

একটি মার্কেটের অভ্যন্তরে, সাধারণ ক্রেতার সামনে, এমন ভয়ভীতিমূলক উক্তি শোনে হতবাক হয়ে যান উপস্থিত সকলে। এমনকি দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে থাকা এক প্রবীণ ভদ্রলোক, যিনি দোকান কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি বলেই ধারণা, তিনিও উক্ত বিক্রেতার পক্ষে সুর মিলিয়ে অশালীন আচরণে যুক্ত হন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিশুটি তখন মায়ের আঁচল আঁকড়ে কেঁদে ওঠে – এই ভয়াবহ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে যায় নিরপরাধ শিশু।

ভুক্তভোগী পরিবার ঘটনার পর গভীর মানসিক চাপে পড়ে এবং পরদিন চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং: ৯০, তারিখ: ০২/১১/২০২৫) দায়ের করেন।

আইনের দ্বারস্থ ভুক্তভোগী – চকবাজার থানার ডিউটি অফিসার মুর্শিদা বেগম জিডিটি গ্রহণ করেন এবং এএসআই (নিরস্ত্র) মোঃ ওমর ফারুক বিষয়টি প্রাথমিকভাবে তদন্ত শুরু করবেন বলে জানান প্রতিবেদককে ।

সচেতন সমাজের ক্ষোভ – আস্থা ভেঙে পড়ছে বাজার সংস্কৃতিতে – বন্দর–ইপিজেড–পতেঙ্গা সচেতন নাগরিক সমাজ, নারী অধিকার সংগঠন ও বলছেন, এই ঘটনা কেবল একজন সেলসম্যানের ঔদ্ধত্য নয় – এটি সমগ্র বাজার সংস্কৃতির এক ভয়াবহ অবক্ষয়। সেন্ট্রাল প্লাজার মতো মর্যাদাপূর্ণ মার্কেটে নারী ক্রেতা যদি অপমানিত হন, তবে সেই বাজার শুধু পণ্য বিক্রি নয় – মানবিক মূল্যবোধ বিক্রিরও দায়ে অভিযুক্ত।

এক নারী অধিকারকর্মীর তীব্র মন্তব্য, যেখানে মায়ের মর্যাদা অপমানিত, সেখানে ব্যবসা নয়—চলছে নৈতিক দেউলিয়াপনা। বাজারের শালীনতা রক্ষায় জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন।

বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে এখন সময় এসেছে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের জন্য নৈতিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার। কারণ, এক বিক্রেতার অবমাননাকর আচরণ পুরো মার্কেটের সুনাম ধূলিসাৎ করতে পারে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে, নারীরা আর নিরাপদ মনে করবেন না কোনো শপিং মলকে – যা শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়িক বিশ্বাসহীনতা ও সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি করবে।

এই ঘটনাটি নিছক একটি জিডি নয় – এটি একটি প্রতিরোধের দলিল। একজন মা ও মেয়ের আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ হওয়ার পেছনে লুকিয়ে আছে আমাদের নীরবতা, আমাদের অবহেলা। সেন্ট্রাল প্লাজার মতো নামী মার্কেট যদি এমন অসভ্যতার সাক্ষী হয়, তবে সেটি শুধু বাণিজ্য নয় – মানবিকতা হারানোর এক জ্বলন্ত দলিল।

এখন প্রয়োজন উদাহরণমূলক শাস্তি ও সামাজিক জবাবদিহিতা – যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো ‘মাদার ড্রিম’-এর দেয়ালের আড়াল থেকে নারীর মর্যাদা নিয়ে ঠাট্টা করার দুঃসাহস না দেখায় কোনো সেলসম্যান বা দোকান মালিক।