
মো. আবু শাহেদ, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে লালিয়ারহাট হামিদিয়া হোছাইনিয়া রজ্জাকিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও এতিমখানায় সাবেক ইউএনও ও ডিজি প্রতিনিধির সাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে মাদ্রাসার এমপিও ভুক্তিতে নিয়োগবিহীন শিক্ষকদের নাম এমপিওভুক্ত করণে ম্যানেজিং কমিটির বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া
গেছে। সূত্রে জানা যায়, ওই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে হাটহাজারী উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা জিষু রায় চৌধুরী ও ডিজি প্রতিনিধি চট্টগ্রাম মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার মুফাসসির ছালেকুর রহমানের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে দশজন শিক্ষক কে অবৈধ নিয়োগ দেন। এরমধ্যে নয়জন কে এমপিও ভুক্ত করে এবং আরেকজনকে এমপিওভুক্ত করার তবদিরের তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দীর্ঘদিন থেকে কর্মরত সুপার ফরিদুল আলম, সহ- সুপার নুরুল হক, সহকারি মৌলানা শফিউর রহমান সহ কয়েকজনকে বাদ দিয়ে এবং পরবর্তীতে সাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে সহ-সুপার নুরুল হককে ডিমোশন করে সহকারি মৌলানা পদে নিয়োগ দেখায়।
সহকারি মৌলভী আবুল কাশেমকে অবৈধভাবে সহ-সুপার পদে নিয়োগ দেখায়। অথচ সরকারি ব্যানবেইস সহ সকল জরিপে নুরুল হক সহ- সুপার পদে এবং আবুল কাশেম সহকারী মৌলভী পদে উল্লেখ আছে। আমিনুল হক, আব্দুল মালেক ও জসীমউদ্দীনকে পূর্বের তারিখ দিয়ে ভুয়া পত্রিকা তৈরি করে। হাটহাজারী উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা ও ডিজি প্রতিনিধির সিল স্বাক্ষর জালিয়াতি করে শিক্ষক এমপিওভুক্ত করা হয়। এতে নির্যাতিত শিক্ষকগণ কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দাখিল করলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। নির্বাহী কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয় ২০০০,২০০৪ ও ২০১৪ সালে ভুয়া নিয়োগ বোর্ড গঠন করে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ না করে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাক্ষর জাল-জালিয়াতি মাধ্যমে মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষককে এমপিও ভুক্ত করা হয়। ২০০৪ সালে কোন পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে ২৭ অক্টোবর ২০০৪ইং তারিখের দৈনিক আজাদী পত্রিকা নকল করে বিজ্ঞপ্তি দেখায়। অথচ মূল পত্রিকায় মাদ্রাসার কোন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। বিগত ২৫ নভেম্বর ২০০৪ইং তারিখে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দেখানো হয়েছে উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা জহির উদ্দিন বাবর ও ডিজি প্রতিনিধি চট্টগ্রাম মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহমদ ছফা কে। কিন্তু জানা যায়, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি ১৩ মার্চ ২০০৫ থেকে ১ জানুয়ারি ২০০৯ পর্যন্ত। উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা জহির উদ্দিন বাবরের স্বাক্ষর, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সাইফুল ইসলাম ও ওই মাদ্রাসার তৎকালিন সুপার ফরিদুল আলমের সিল স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ইবি প্রধান পদে আমিনুল হককে এবং ইবি জুনিয়র মৌলভী পদে আব্দুল মালেককে নিয়োগ দিয়ে এমপিওভুক্ত করা হয়।
২০১৪ সালে কোন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে, ও নিয়োগ পরীক্ষা না নিয়ে ১৭ অক্টোবর ২০১৪ইং তারিখের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার ভুয়া বিজ্ঞপ্তি তৈরি করে। চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান
শিক্ষিকা মাহবুবা বেগমের স্বাক্ষর ও মাদ্রাসা সুপার ফরিদুল আলমের স্বাক্ষর সহ সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল- জালিয়াতি করে জসীমউদ্দীনকে নিয়োগ দেখিয়ে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা যায়।
ওই মাদ্রাসার তৎকালীন সুপার ফরিদুল আলম বলেন, মাদ্রাসা ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক জাল-জালিয়াতি ও নানা দুর্নীতির প্রসঙ্গে অভিযোগ করিলে তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রেরিত ২৫ জানুয়ারি ২০২১ইং তারিখের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় নির্যাতিত শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আমি চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করি। সিআর মামলা নং ৫৮৫/২১। আদালত বিষয়টি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব প্রদান করে। পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা কামাল আব্বাস দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণ করে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদেরকে নিরপক্ষ সাক্ষী দেখিয়ে প্রকৃত ঘটনাকে গোপন করে সম্পূর্ণ বানোয়াট প্রতিবেদন দেন।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদনে ওই মাদ্রাসার সহ- সুপার ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল কাশেম বলেন, জাল-জালিয়াতির ও দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটি হাইকোর্টের
নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ। তৎকালীন সুপার মোঃ ফরিদুল আলম নিজের ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে বৈধভাবে সহ- সুপার পদে নিয়োগ হওয়ার পরও তাকে উক্ত পদে কখনো আসতে দেননি। বরং তিনি সহকারি মৌলভী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত নুরুল হক কে সহ-সুপার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফরিদুল আলম পদত্যাগ করার পরেই নুরুল হক সহ- সুপার পদে দায়িত্ব পালনে অক্ষম বিধায় তার দাবি অনুযায়ী পরিচালনা কমিটি ২০০০ সালের রেজুলেশন মতে সহকারি সুপারের পদাধিকার বলে আমাকে ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে সভায় ভারপ্রাপ্ত সুপার দায়িত্ব প্রদান করেন।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি খালেদ ইবনে ইউসুফ বলেন, মাওলানা ফরিদুল আলম দীর্ঘদিন পর্যন্ত মাদ্রাসার অনেক টাকা পয়সা খরচ করে। মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে অন্যত্র অধিক বেতন-ভাতার চাকুরি লাভ করে মাদ্রাসার চাকুরি হতে ইস্তফা দিয়ে চলে যান। বিগত ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে পরিচালনা কমিটির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় এবং ওই তারিখেই মাদ্রাসার সহ- সুপার মাওলানা আবুল কাশেম সাহেবকে ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
এদিকে হাটহাজারী উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনের তদন্ত প্রতিবেদনে জানান, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ২০০০ সালের মতো ২০০৪ সালেও ভুয়া নিয়োগ বোর্ড গঠন করে। সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ না
করে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে উক্ত মাদ্রাসায় জনবল নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে এবং সম্পূর্ণ জালিয়াতির উপর ভিত্তি করেই মাদ্রাসার বিভিন্ন শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। হয়তো অভিযোগকারীরা যদি অভিযোগ না করতেন তাহলে কোনদিন এসব দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতির প্রকাশ হত না। বিষয়টি অবগতির জন্য ও পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়েছে।