
কুমিল্লা প্রতিনিধি: কচু পুষ্টিকর সবজি হলেও এর পুষ্টি অনুযায়ী কদর নেই আমাদের দেশে। ফলে চাষাবাদও হয় কম। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করে মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবধানে বড় সম্ভাবনা জাগিয়েছেন কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার কৃষকরা। এ অঞ্চলের কচু ও লতি দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহের পাশাপাশি রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ২৮টিরও বেশি দেশে। প্রবাসীদের পাশাপাশি বিদেশিদের কাছে দিন দিন এর কদর বাড়ছে। সরেজমিনে মুরাদনগর উপজেলা ঘুরে জানা গেছে, কম খরচে বেশি লাভ এবং দীর্ঘদিন ফলন পাওয়ার কারণে কৃষকরা এখন বাণিজ্যিকভাবে কচু আবাদ করছেন। এরই মধ্যে কচুর উপজেলা হিসেবে ‘বিখ্যাত’ হতে শুরু করেছে বরুড়া। কচু আর লতিকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও। এ অঞ্চলে কৃষকদের সাফল্য দেখে অন্যান্য জেলা থেকেও চারা সংগ্রহ করতে আসছেন কৃষকরা। গত মৌসুমে বরুড়া থেকে প্রায় এক লাখ কচুর চারা গেছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। স্থানীয় কৃষি বিভাগও কচুর উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
কৃষি বিভাগ ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, বরুড়ায় উৎপাদিত পানি কচু ও লতি বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে, দুবাই, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের প্রায় সব দেশে যাচ্ছে। আগে এই লতি ও কচু প্রবাসীদের মাধ্যমে গেলেও গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে রপ্তানি হচ্ছে। চিটাগং ফ্রেশ ফ্রু্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে এই সবজি দুটি। প্রতিষ্ঠানটির সহসভাপতি এবং চিটাগং ফুডস ও ভেজিটেবলের স্বত্বাধিকারী মো. ইসমাইল চৌধুরী হানিফ বলেন, ‘আমরা ১৯৯৫ সাল থেকে মুরাদনগর ও বরুড়ার পানি কচু ও লতি রপ্তানি করছি। ২০১০ সালের পর থেকে ব্যাপক হারে রপ্তানি হচ্ছে এবং প্রতি বছরই বিদেশে এ দুটি সবজির চাহিদা বাড়ছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে যাচ্ছে দুবাই। আর ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ ২৫টির বেশি দেশে।
’ তিনি বলেন, ‘বিদেশিদের পছন্দ সবুজ লতি ও কচু। বরুড়ার এই দুটি পণ্যই সুস্বাদু, ফলে বিদেশিদেরও পছন্দের। ’ তিনি আরো বলেন, ‘রপ্তানিতে আমাদের একমাত্র সমস্যা হচ্ছে সড়কে চাঁদাবাজি। বরুড়া থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম পণ্য আনতে পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। এতে ক্রেতা পর্যায়ে দাম অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া আর তেমন কোনো সমস্যা নেই। ’ স্থানীয় পাইকার বা ব্যাপারীরা প্রতিদিনই কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কচু ও লতি সংগ্রহ করছেন এবং রপ্তানিকারকদের দিচ্ছেন। বাড়িতে নারীরা এসব লতি ও কচু পরিষ্কার করে আঁটি বাঁধেন। এতে অন্তত এক হাজার নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। চাষিরা বলছেন, তাঁরা সরাসরি রপ্তানিকারকদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারলে বেশি লাভবান হতেন। এখন লাভের একটা বড় অংশ খেয়ে ফেলে মধ্যস্বত্বভোগীরা। উপজেলার আগানগর গ্রামের বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমি ১৭ শতাংশ জমিতে লতি কচুর চাষ করেছি। এতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। বিক্রি করব প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। প্রতি সপ্তাহে একবার লতি তুলে বিক্রি করি ব্যাপারীদের কাছে। গত ৪০ বছর ধরে আমরা লতি চাষ করছি। আগে না করলেও বর্তমানে আমাদের এলাকার বেশির ভাগ কৃষকই লতি চাষ করছেন।
’ উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুফি আহমেদ বলেন, ‘ধান চাষের চেয়ে এখানে কচু চাষ বেশি লাভজনক। লতির ফলন শুরু হলে সাত দিন পর পর কৃষকরা তা বিক্রি করতে পারেন ৯ মাস পর্যন্ত। তিনটি ইউনিয়নে ব্যাপকহারে কচুর চাষ হচ্ছে। আমাদের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। ’ স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ-ছয় বছর আগে ধানের দাম কম থাকায় এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কচু চাষে ঝুঁকে পড়েন। ওই সময় কৃষকরা কম খরচে বেশি লাভ এবং কচুর লতির ব্যাপক চাহিদা দেখে বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেন। কৃষি অফিসের তথ্যমতে, উপজেলার মোট ২৫০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কচুর চাষ হচ্ছে। উৎপাদন করছেন প্রায় চার হাজার চাষি। প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ২৫ টন পর্যন্ত লতি উৎপাদিত হয়। সময়ভেদে এসব লতি টনপ্রতি ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন চাষিরা। এ উপজেলায় মূলত দুই জাতের কচুর চাষ হয়ে থাকে। এগুলো হলো লতিরাজ ও বারি পানি কচু-৩। এর মধ্যে লতিরাজ স্থানীয়দের কাছে লতি কচু নামে পরিচিত। এই কচু থেকে শুধু লতি সংগ্রহ করা হয়। আর পানি কচু থেকে মোটা সাইজের লতি, মূলসহ কচু সংগ্রহ করা হয়। মো. নজরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘সরকারের ‘কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্পে মুরাদনগর ও বরুড়া উপজেলা রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বিষমুক্ত উপায়ে কচুসহ সবজি উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’