কোন ধর্মের প্রথম কথা ‘ইকরা’ (পড়) নেই, পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রথম কোরআনের বাণী ইকরা ‘পড়’। কোরআনের প্রথম নাজিল হয় প্রথম পাঁচটি আয়াত। এ পাঁচটি আয়াত অন্যকোন বিষয় সম্পর্কিত নয়, জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের। এই পাঁচটি আয়াতের ক্রম অনুসারে সরল অনুবাদ (১) পাঠ কর আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, (২) যিনি সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে জমাটবাঁধা রক্তপিণ্ড থেকে, (৩) পাঠ কর, আপনার রব অত্যন্ত দয়ালু বা মহিমান্বিত, (৪) যিনি শিক্ষা দিয়েছেন, কলমের মাধ্যমে, (৫) তিনি শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে যা সে জানতো না। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, ‘ইকরা’ (পড়) শব্দটি যখন নাজিল হয়েছে তখন ইসলাম ধর্মের কোন জ্ঞান বিজ্ঞান ছিল না, তাই এই ইকরা (পড়) শব্দটি দ্বারা আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন সব ধর্মের জ্ঞান, বিজ্ঞান প্রযুক্তি আত্মস্থ করতে।
প্রথম নাজিলকৃত পাঁচ আয়াত হতে স্পষ্ট বুঝা যায়, অজানাকে জানার নাম শিক্ষা। যা সাধারণত জানি তা মৌলিক শিক্ষা নয়, ধারণা মাত্র। যেমন আগুনে হাত দিলে পুড়ে যাবে, গরুর রচনা লিখতে গরুর কয়টি পা আছে, কয়’টি শিং ইত্যাদি ইত্যাদি জানা জ্ঞান নয়,ধারণা মাত্র। যা অজানা-চিন্তাশীল তা হলো প্রজ্ঞা। ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, ‘আমাদের বিদ্যা আসে প্রজ্ঞা আসে না।’ পবিত্র কোরআন পড়তে বলা হয়েছে অজানাকে জানার জন্য। না বুঝে কোরআন পড়তে বলা হয়নি। পবিত্র কোরআনে সব জ্ঞান আছে তা এই মহাগ্রন্থে আল্লাহ পাকের ঘোষণা রয়েছে। সব জ্ঞান যদি কোরআনে থাকে তাহলে সবজ্ঞানই কোরআনিক, সব জ্ঞান ইসলামে। জ্ঞানের গুরুত্ব বুঝতে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ৮৬৮ বার জ্ঞান অর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন।
শিক্ষা সভ্যতার বাহন আর সভ্যতা প্রগতির বাহন। আল্লাহ পাক মানব জাতিকে সভ্য ও প্রগতির দিকে নিয়ে যেতে যুগে যুগে নতুন নতুন বিধান নিয়ে নবী রাসুল (দ.) প্রেরণ করেছেন। হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করে সর্বপ্রথম জ্ঞান দান করেছেন। জ্ঞানের কারণে আদম (আ.) মর্যাদাবান হয়েছিলেন, ইবাদতের কারণে নয়। জ্ঞান বিজ্ঞান অর্জন আদর্শ সন্তানদের জন্ম গত অধিকার। ইবাদতে, বয়সে, আগুনের তৈরি হিসেবে শয়তান উত্তম হলেও জ্ঞানে ছিলেন আদম(আ.) উত্তম। তাই জ্ঞানের কারণেই আল্লাহ পাক, আদম (আ.)কে সেজদা করতে শয়তানের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন। জন্মিলে পশু হয়, মানুষ হয় না, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। পশুকে পশু হওয়ার এবং পশুকে মানুষ হওয়ার আহবান জানানো হয় না, একমাত্র মানুষকে মানুষ হওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়।
যে ব্যক্তি মানুষ এবং অমানুষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না সে অমানুষ। মানুষ ও অমানুষের পার্থক্য করতে শিখায় মানুষের জ্ঞান। জ্ঞান হতে যদি বিবেক জাগ্রত না হয় সে পশু। কথায় আছে, ‘মানুষ জন্মে শিশু, শিক্ষায় যিশু,না হলে পশু’। শিক্ষার কারণে মানুষ মানুষ হয়ে উঠে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, গুণতে আমরা বৃদ্ধি পাচ্ছি গরু ছাগলের মত। বর্তমান দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা কমছে মানুষ। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে হিংসা ক্ষোভ রাগ জন্মগত থাকে। এসব নিয়ন্ত্রণ করার কঠোর সাধনায় মানুষ মানুষ হয়ে উঠে। সম্পদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ মানব সম্পদ, যদি তার মধ্যে জ্ঞান ও প্রযুক্তি থাকে। তাই ব্যক্তি জীবনে সম্পদ অর্জনের চেয়ে জ্ঞান অর্জনই করা উচিত। চোখের আলোয় নয় জ্ঞানের আলোয় আজকের একুশ শতকের পৃথিবী আলোকিত, আলোড়িত এবং বিস্মিত।
শিক্ষা কী তা আমাদের আগে বুঝতে হবে। তা যদি না বুঝি আমরা শিক্ষিত হবো কীভাবে! মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করার জন্য যে শিক্ষা সে শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। বিশ্ব জগতের প্রতিটি মানুষ এক একটি সৈনিক। জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার তাগিদে শিক্ষা অর্জনই প্রধান হাতিয়ার। বর্তমান আমরা শিক্ষা বলতে বুঝি ‘উচ্চতর ডিগ্রি’ আর জীবনে প্রতিষ্ঠা বলতে বুঝি ‘অর্থ ও পতিপত্তি’। শিক্ষা, মনুষ্যত্ব আর জীবনের সত্যিকার উন্নতির অর্থ বুঝি না। জ্ঞান দুই প্রকার, ভালো ও মন্দ। ভালো জ্ঞান দুই প্রকার (১) যা শিখে জীবন বাঁচে, (২) যে জ্ঞান আদর্শ শিখায়। যা শিখে জীবন বাঁচায় সে জ্ঞান শিখা প্রথম অপরিহার্য যা দ্বারা জীবন যাপন করি। যেমন-চিকিৎসা, কৃষি, গণিত, বিজ্ঞান। এসব জ্ঞান না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য।
তাই পবিত্র কোরআনে নাজিলকৃত প্রথম পাঁচটি আয়াত জ্ঞান ও বিজ্ঞানেরই। আজ স্কুল কলেজ মাদ্রাসার কোনটি শিক্ষাই পূর্ণাঙ্গ নয়। তাই জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। মাদ্রাসা শিক্ষায় নেই আধুনিকতা, স্কুল কলেজের শিক্ষায় নেই আদর্শ শিক্ষা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক যেসব বিষয়ে শপথ গ্রহণ করেছেন সেসব বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ এবং মর্যাদাবান। পবিত্র কোরআনে সূরা কলমের শুরুতে আল্লাহ পাক কলমের শপথ গ্রহণ করে জ্ঞান অর্জনের এই মাধ্যমকে সম্মানিত করেছেন। পবিত্র কোরআনের আর একটি মর্যাদাবান সূরা ইয়াসিন। এই সূরার শুরুতে মহান আল্লাহ পাক বিজ্ঞানময় কোরআনের শপথ করে বিজ্ঞানময় কোরআনের মার্যাদাই বৃদ্ধি করে দিয়েছেন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আলিমগণ নবীগনের ওয়ারিশ। নবীগণ কাউকে দীনার ও দিরহামের ওয়ারিশ করেননি, তারা শুধু ইলমের ওয়ারিশ করেছেন।’ আরবী প্রবাদ আছে, ‘আল ইলমুনুরুন’ জ্ঞান হলো আলো। যা অন্ধকারকে দূর করে, আলোকিত করে সমাজ। যে সব জ্ঞান দেশকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তা জ্ঞান নয়, দৈহিক মানসিক আধ্যাত্মিক আলোর নাম জ্ঞান। কবি মিল্টন বলেছেন, ‘জ্ঞান শরীর মন ও আত্মার উন্নতি করে’।এসবের উন্নতি যে শিক্ষা করে না তা প্রকৃত জ্ঞান নয়। মহানবী (দ.)’র আগমনের পূর্বেক্ষণে আরব জাতির মধ্যে সাহিত্য, সংস্কৃতি, কাব্যচর্চা, ভাষাজ্ঞান ইত্যাদি ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার অভাব ছিল বলে ‘অন্ধকারযুগ’ বলা হয়। মহানবী (দ.) নৈতিক শিক্ষার গুরুত্বই ব্যাপক ভাবে প্রদান করেছিলেন।
(লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক)