তাহিরপুরে ত্রাণের জন্য বানভাসিদের হাহাকার: বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে ভানবাসীদের দুর্ভোগ

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ তাহিরপুরে ত্রাণের জন্য বানভাসিদের হাহাকার, বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে বানভাসিদের দুর্ভোগ। এই ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে সবকটি গ্রাম। ঘরেবাহিরে পানি কোথাও তিল পরিমান ঠাই নেই। আশ্রয়, খাবার ও বিশুদ্ধ পানিয় জলের অভাবে বানভাসি মামুষেরা দূর্দশাগ্রস্ত দিশেহারা। বানভাসি মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই! তাহিরপুর উপজেলায় চলছে মানবিক বিপর্যয়। ঘরে ঘরে বন্যার পানি। পানিবন্দি মানুষ রান্না বন্ধ পয়নিস্কাশন সমস্যা। ঘরে বাহিরে চলছে কান্নার রোল। বানভাসিদের কন্নায় ভারি তাহিরপুরের আকাশ বাতাস। এবারের বন্যা ভয়াবহতা দিনদিন  বেড়েই চলেছে, বিগত ৫০ বছের ইতিহাসে এবারের বন্যার ভোগান্তি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি। পানিবন্দি হযে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। নেই বিদ্যুত। বিশুদ্ধ পানির সংকট, পয়নিস্কাশের সমস্যা। খাদ্য সংকটে দিনরাত পার করছে ভানবাসী মানুষ জন। সবচেয়ে ভোগান্তির মধ্যে  বানভাসি মানুষ তাদের গৃহীতপালিত পশু গরু ছাগল নিয়ে।

এদিকে বানভাসি মানুষ ঘর ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে দ্বিকবিদিক ছুটছে। তাদের গৃহপালিত পশু নিয়েও পড়েছেন বিপাকে। যেখানেই ছুটছেন গৃহপালিত পশুদের সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক পরিবারের নিজস্ব নৌকা না থাকায় দীর্ঘ সময় ধরে পানিবন্দি অবস্থায় বাড়িঘরে আটকা পড়ে থাকতে হচ্ছে। তাছাড়া হাট-বাজারগুলোতে পানি ঢুকে পড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। এসব বানভাসি মানুষের জন্য এখন শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ আশ্রয় জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে জনমনে ভীতি আর উৎকন্ঠা কাজ করছে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে পানি ঢুকে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে গোটা তাহিরপুর উপজেলা। আর এই সুযোগে চিড়া, মুড়ি, কুপিবাতি, মোমবাতি, গ্যাস সিলিন্ডারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটতে ব্যস্ত এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন এত পানি এর আগে তারা কখনো দেখেননি। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আরো ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় বন্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। স্থানীয় শতবছরের অনেকেই বলছেন এই বন্যা ২০০৪,১৯৮৮ কিংবা ১৯৭৪  সালের বন্যার চেয়েও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।  বাসা বাড়িতে পানি থাকায় রান্না করতে না পারায় সবচেয়ে বেশি খাদ্য সংকটে ভুগছ বানভাসি মানুষ । মানুষের সেয়া বছরের খুরাক ধান চাল সবাই পানির নিচে।বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। নেই বিদ্যুৎ। অনেক এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত। গত ২/৩ দিন ধরে নেই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মোবাইল নেটওয়ার্ক। জরুরী ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন।  যারা দিনমজুর তারা কাজে যেতে পারছেন না। আয় রোজগার বন্ধ। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের সাথে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। এদিকে তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছ, সরকারি বেসরকারি মিলে ১৫০ টি আশ্রম কেন্দ্রে খোলা হয়েছে। এতে ৫ হাজারেরও অধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের ৫ টি টিম বিভিন্নভাবে ভাগ হয়ে উপজেলাব্যাপী উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং বন্যার্তদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এমপি তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও মোহাম্মদ রাহান কবির আশ্রম কেন্দ্রে সরেজমিন পরিদর্শন করে আশ্রম কেন্দ্রে ঠাই নেয়া বানভাসিদের মধ্যে রান্নাকরা খাবার বিতরণ করেন।সরেজমিনে রবিবার দুপুরে শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের মনদিয়াতা সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রম কেন্দ্র গিয়ে এর আশপাশের প্রায় ১০০ পরিবারের অধিক পরিবার আশ্রয় নেয় সেখানে, গৃহপালিত পশু গরু ছাগল শিশুদের নিয়ে প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ গত ৫ দিন ধরে খেয়ে না খেয়ে দিনরাত পর করছেন। মুজরাই, কামালপুর, মনদিয়াতা, জয়পুর,গুলাবাড়ি সহ ৫/৭ টি গ্রামের মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে কথা হয় হামিদা বেগম ( ৭০) এর সাথে।  তারা এসময় কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমারা খালি পিরানের কাহর ডাইই( কাপড়) বাবা লইয়া আছি। আমরা ঘর(ঘরে) পাও ফালাইবার জাগা নাই বাবা, খালি পানি আর পানি। কোন রকম বাচ্চাকাচ্ছা নিয়া এই খানে আইছি বাবা, ৩/৪ দিন ধরে খানি জাই,  বাড়ির সব পানির নিচে। খুব কষ্ট করে বৈশাখেও পানির তল থাইকা ধান তুলছি। তাও পানির নিচে এখন পানি কমলেই কি না কললেই কি। পানি কমলেও খাওয়ার লাগি মরমু না কমলেও মরমু।  আল্লা আমারারে একেবারে নিয়া গেলনা কেন। বাইচ্ছা তাইক্কা এখন আর লাভ নাই। খানির জ্বালায় মরমু। শুধু হামিদা বেগমেই নয়! আশ্রম কেন্দ্রে আশ্রয় নেয় হামিদার মতো শাহানা বেগম (৩৫),  নুরেজা বেগম (৬৯) প্রায় শতাধিক নারী পুরুষ শিশু কিশোরের একই ভাষ্য।

দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের বড়দল বাগবাড়ি আশ্রম কেন্দ্রে দিলরাজ(৭০) পানিতে  সবকিছু হারিয়ে এখানে ৩ দিন ধরে আশ্রয় হিয়েছি। দুইদিন ধরে না খেয়ে আছি। আজকেই  প্রথম ইউএনও স্যার এসে খাবার দিছেন। বাবা এই বন্যার পানিতে আমারা সব শেষ। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, উপজেলার সব বাড়িঘরেই পানি। এবারের বন্যার ভয়াবহতা খুব বেশি। তবে এখনো পর্যন্ত কোন হতাহতের খবর পাইনি। সরকারি বেসরকারি মিলে ১৫০ টির মতো আশ্রম কেন্দ্রে ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ২/৩ দিন মোবাইলের নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় আমরা বাহির থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে দেয়া সম্ভব হয়নি। আজ মোবাইলের নেটওয়ার্ক আসার পর সব জায়গায় ম্যাচেজ পাঠিয়েছি। বানভাসিদের খাদ্যর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল পাবো। এর আগে আমরা যা করেছি তাহিরপুর থেকে খাবার রান্না করে বিভিন্ন আশ্রম কেন্দ্রে দিয়েছি। আমাদের শুকনো খাবার গুলো চলে আসলে  আমরা চেষ্টা করবো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা গুলোতে পর্যাক্রমে দেয়ার। আজকের যে আবহাওয়া এ আবস্থা ২/৩ দিন এরকম থাকলে বন্যার উন্নতি হতে পারে আবার ঢলের পানি বাড়লে অবনতিও হতেপারে।এই পরিস্থিতি মাথায় রেখে আমরা প্রস্থুতি নিচ্ছি। যেকোনোভাবে যেকোনো মূল্য জনগণকে আমরা বাঁচি রাখতে চাই। উপজেলায় যেখানে এক থেকে দেড় লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত সেখানে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে বানভাসিদের পাশা দাড়ানো সম্ভব না।